বৈশ্বিক প্রিমিয়াম স্মার্টফোন বাজারে খারাপ সময় পার করছে অ্যাপল। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির ডিভাইস ব্যবসায় বাড়তি অনিশ্চয়তা যোগ করেছে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ মহামারী। নতুন স্বাভাবিকতার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে আইফোনের নতুন সংস্করণ উন্মোচন পিছিয়েছে অ্যাপল। তবে মহামারীর মধ্যে হার্ডওয়্যার ব্যবসা নিয়ে খারাপ সময় পার করলেও ডিজিটাল পেমেন্ট ও সফটওয়্যার সেবা খাতে ক্রমে উন্নতি করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামীতে অ্যাপলের ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা ‘অ্যাপল পে’ মাল্টিবিলিয়ন ডলার রাজস্বের ব্যবসায় পরিণত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। খবর ইয়াহু ফিন্যান্স।
বিনিয়োগ ব্যাংক কোয়েন ইনকরপোরেশনের বিশ্লেষক কৃশ শঙ্করের ভাষ্যে, বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজার তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান চীনা ব্র্যান্ডগুলোর কারণে চাপে রয়েছে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো প্রিমিয়াম ডিভাইস নির্মাতারা। এ পরিস্থিতিতে হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অন্যান্য সফটওয়্যার সেবায় মনোযোগ অ্যাপলের জন্য নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। অ্যাপলের রাজস্বে আইফোনের গুরুত্ব কমলেও সেবা বিভাগের গুরুত্ব বাড়ছে।
তিনি বলেন, অ্যাপল ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনয়নের লক্ষ্য থেকে ডিজিটাল পেমেন্ট খাতে প্রবেশ করেছিল, যা এখন প্রতিষ্ঠানটির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ডিজিটাল পেমেন্ট খাতে অ্যাপল পে, অ্যাপল কার্ড এবং অ্যাপল ক্যাশ সেবা দিয়ে ব্যবসা করছে অ্যাপল। এর মধ্যে অ্যাপল পে আগামীতে অ্যাপলের জন্য মাল্টিবিলিয়ন ডলার রাজস্বের ব্যবসায় পরিণত হবে বলে জানান তিনি।
গত সোমবার প্রকাশিত এক রিসার্চ নোটে কৃশ শঙ্কর লেখেন, সাম্প্রতিক সময় ডিজিটাল পেমেন্ট খাতে অ্যাপলের তিন সেবায় ১০০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে নতুন স্বাভাবিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার অংশ হিসেবে অ্যাপলের ডিজিটাল পেমেন্ট সেবাগুলোর ব্যবহার এবং পেনিট্রেশন দুটোই উল্লেখযোগ্য বেড়েছে।
বিশ্লেষক কৃশ শঙ্কর বলেন, অ্যাপল হার্ডওয়্যার ব্যবসার পরিপূরক হিসেবে ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা চালু করেছিল। ভবিষ্যতে এ সেবাগুলোর প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব আয় প্রতিষ্ঠানটিকে পরবর্তী উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। চলতি বছর শেষে অ্যাপলের ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা বিভাগের রাজস্ব আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি, যা আগামী ২০২২ সালের মধ্যে ২০০ কোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করতে পারে।
গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রথমবার অ্যাপলের মোট রাজস্বের ৪৮ শতাংশ আইফোন বিক্রি থেকে আসতে দেখা যায়। অথচ প্রথম প্রজন্মের আইফোন উন্মোচনের পর থেকে বরাবরই প্রতিষ্ঠানটির রাজস্বের সিংহভাগ আইফোন বিক্রি থেকে এসেছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির প্রান্তিকভিত্তিক মোট রাজস্বে আইফোনের গুরুত্ব অর্ধেকের নিচে নামে। ওই প্রান্তিকে অ্যাপলের রাজস্বে আইফোনের গুরুত্ব কমলেও সেবা ও পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্যের বাড়তে দেখা গেছে। গত বছর এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আইফোন বিক্রি থেকে অ্যাপলের রাজস্ব ২ হাজার ৫৯৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়, যা ২০১৮ সালের একই প্রান্তিকের চেয়ে ৩০০ কোটি ডলার কম। গত বছর এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আইফোন বিক্রি থেকে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস পূরণেও ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রান্তিকে আইফোন বিক্রি থেকে অ্যাপলের রাজস্ব ২ হাজার ৬৫৪ কোটি ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস ছিল।
চড়া দামের কারণে টানা কয়েক বছর ধরে আইফোন ব্যবসায় ভালো করতে পারছে না অ্যাপল। পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে এখন প্রতি বছর অন্তত একটি সাশ্রয়ী আইফোন উন্মোচন করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু স্মার্টফোন ডিভাইসকেন্দ্রিক নতুন উদ্ভাবন না থাকায় গ্রাহক সাড়া পাচ্ছে না নতুন আইফোন। এছাড়া চীনা ব্র্যান্ডগুলো তুলনামূলক অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে হাই-এন্ড ডিভাইস বিক্রি করছে, যা অ্যাপলের ডিভাইস ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আইফোনের গুরুত্বপূর্ণ বাজার চীনেও খারাপ সময় পার করছে অ্যাপল। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের পরোক্ষ ভুক্তভোগী অ্যাপল। কারণ প্রতিষ্ঠানটি আইফোন উৎপাদনের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ চীননির্ভর। অ্যাপল অবশ্য আইফোন উৎপাদন কার্যক্রম চীন থেকে ভিয়েতনাম কিংবা ভারতে সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন খাত মিলিয়ে এখন অ্যাপলের কাছে রয়েছে নগদ ২১ হাজার ৬০ কোটি ডলার। অ্যাপল নতুন খাতে ব্যবসা বাড়াতে গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) বিভাগের পাশাপাশি অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণে জোর দিচ্ছে। গত বছরই ১০০ কোটি ডলারে সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি ইন্টেলের স্মার্টফোন মডেম চিপ বিভাগ অধিগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। বিভিন্ন কাজে ব্যয় বাড়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থের মজুদ কিছুটা কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, আইফোনকেন্দ্রিক উদ্ভাবন এখন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। আইফোনের বিক্রি বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা ব্যবসা বিভাগ ও নতুন অ্যাপল টিভি প্লাস স্ট্রিমিংয়ে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে অ্যাপল। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্বে ডিজিটাল পেমেন্টসহ অ্যাপ স্টোর, সফটওয়্যার ও বিভিন্ন সেবা খাতের গুরুত্ব ক্রমে বাড়ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগে বাধ্য হচ্ছে অ্যাপল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে টেক্সাসের অস্টিন ক্যাম্পাসে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্যাম্পাসটিতে ১৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করছে অ্যাপল। এছাড়া আগামী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।